কর্তব্যের চাপ আকাশছোঁয়া, পারিশ্রমিক ও সম্মান তলানিতে এটাই পশ্চিমবাংলার সিভিক ভলান্টিয়ারদের জীবন
কাজলকান্তি কর্মকার [Ghatal || M:9933066200]: ২০১৩ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে সহায়তার জন্য সিভিক ভলান্টিয়ার (Civic Volunteer - CV) বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, তখন রাজ্যের লক্ষাধিক বেকার যুবকের কাছে এটি ছিল এক নতুন আশার আলো। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, উৎসবের ভিড় সামলানো এবং সাধারণ জননিরাপত্তার মতো কাজে পুলিশকে সাহায্য করার জন্যই মূলত তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যের পরিধি বাড়লেও, পারিশ্রমিক আর সামাজিক সম্মানের ক্ষেত্রে এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর আক্ষেপ আজ চরমে। পুলিশের 'সহায়ক' এই বাহিনীর জীবন যেন 'মিষ্টি বিষ'-এর মতো— শুরুতে আকর্ষণীয় হলেও ধীরে ধীরে তা বিষময় হয়ে উঠছে। সিভিক ভলান্টিয়ারদের আক্ষেপ ও অভিযোগগুলি বিশ্লেষণ করে একটি স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে, যেখানে একদিকে তাঁদের ওপর অমানবিক কাজের চাপ, অন্যদিকে পরিবার এবং সমাজে সম্মান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা।
আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা: কম বেতন, বেশি খরচ: বর্তমানে সিভিক ভলান্টিয়াররা মাসিক প্রায় ১০,০০০ টাকা ভাতা পান। একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের আক্ষেপের সুরে উঠে এসেছে, প্রথম দিকের ৫৫০০ টাকা ভাতা এখন হয়তো ১০,০০০ টাকা হয়েছে, কিন্তু সংসার খরচ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কাজের জন্য বাড়তি খরচ যোগ করলে পরিবারকে দেওয়ার জন্য সেই ১০ বছর আগের সমপরিমাণ টাকাই অবশিষ্ট থাকে।
•অতিরিক্ত ডিউটির চাপ ও খরচ: পুলিশ কর্মীদের মতোই তাঁদেরও ডিউটির চাপ প্রচুর। অথচ, ডিউটি বা কাজের চাপ বাড়লে বা ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে রাতে ডিউটি দেওয়া হলেও বাইকের পেট্রল খরচ দেওয়া হয় না। ফলে পকেটের টাকা খরচ করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়।
•পরিবারে খারাপ অবস্থান: নামমাত্র বেতনের কারণে বাড়িতে চাহিদা মতো টাকা দিতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের দাবি, আবদার মেটাতেও পারেন না। ফলস্বরূপ, পরিবারেও সিভিক ভলান্টিয়ারদের অবস্থান ভালো থাকে না। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পরিবারে তাঁদের যেমন সম্মান থাকে না। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারে মর্যাদা পান না।
•অবসরকালীন সুবিধা: সম্প্রতি রাজ্য সরকার সিভিক ভলান্টিয়ারদের অবসরকালীন ভাতা ২-৩ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করার ঘোষণা করেছে, যা এককালীন দেওয়া হয়। তবে, নিয়মিত মাসিক পেনশন বা অন্যান্য স্থায়ী কর্মীদের মতো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এই বিপুল সংখ্যক কর্মীদের ভবিষ্যৎ জীবন চরম অনিশ্চয়তায় থাকে। তাঁদের অভিযোগ, ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠন তৈরি হলেও দীর্ঘ আট বছর ধরে তাঁদের ভাতা বৃদ্ধি তেমন উল্লেখযোগ্য হয়নি।
কাজের পরিবেশ ও সামাজিক সম্মানের অভাব: একজন স্থায়ী পুলিশ কর্মীর মতো সমান চাপ ও কাজ করলেও সিভিক ভলান্টিয়াররা পান না কোনও সম্মান। বরং তাঁদের অভিযোগ, কাজ করতে গিয়ে একদিকে পুলিশ কর্মীরা, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ— সবাই নানাভাবে হেনস্থা করেন।
•'তুইতোকারি' সংস্কৃতি ও চরম অপমান: তাঁদের আক্ষেপ, তাঁদের থেকে কম নম্বর পাওয়া এবং ১০-১২ বছর পরে চাকরিতে আসা কমবয়সী যুবকটি পুলিশ বিভাগে যোগদান করে 'স্টারের দৌলতে' অবলীলায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের 'তুই-তোকারি' করে কথা বলেন এবং নিজের 'যোগ্যতাকে জমিদারি মেজাজে' জাহির করেন। ডিউটি বা কাজে সামান্য ভুল হলেই চরম অপমানিত হতে হয়, যা তাঁদের মানসিক চাপ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়।
•উৎসবেও বঞ্চনা: উৎসবের মরশুমে, যেমন দুর্গাপূজার সময়, এক থানা থেকে অন্য থানায় ডিউটি দেওয়া হয়। পুজো বা উৎসবে সিভিকরা পরিজনদের সময় দিতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে কমিটির পক্ষ থেকে খেতেও দেওয়া হয় না, ফলে সারা রাত ডিউটি করার পর গাঁটের টাকায় খেতে হয়— এই আক্ষেপ তাঁদের বঞ্চনার চরম চিত্র তুলে ধরে। অনেকে বলবেন, পুলিশরাও তো পরিবার পরিজনদের সময় দিতে পারেন না। কথাটা ঠিক। কিন্তু তারা সময় না দিতে পারলেও পরিবর্তে পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে অনেক ক্ষেত্রে তারা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সিভিকরা তা পারেন না।
•হেলথ ইনস্যুরেন্সের অভাব: কিছু দিন আগে পর্যন্ত সিভিক ভলান্টিয়ারদের মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা থাকলেও সম্প্রতি তা অজানা কারণে নেই। এটা এক বড় বঞ্চনা। অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার সময় এই নিরাপত্তা না থাকা তাঁদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও বঞ্চনা: সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজের গুরুত্ব কিন্তু কোনও অংশে কম নয়। সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার ফলে গ্রামেগঞ্জে মারামারি, হানাহানি বন্ধ করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের ভিড় সামলানো, এমনকি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা কমাতেও তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পরও আর্থ-সামাজিক ও মানসিক ভাবে বঞ্চিত হওয়াটা তাঁদের কাছে বড়ই আক্ষেপের। বহু সিভিক বিশ্বাস করেন, সঠিক বেতন ও সম্মান পেলে সিভিক ভলান্টিয়াররা উপযুক্ত পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগ: রাজ্য সরকার যদিও সিভিক ভলান্টিয়ারদের সুবিধার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
•২০২৪ সালের বাজেটে সিভিক ভলান্টিয়ারদের মাসিক ভাতা ১,০০০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে (১০ হাজার টাকা হয়েছে) এবং পুলিশ বাহিনীতে সিভিক ভলান্টিয়ারদের জন্য চাকরি সংরক্ষণের হার ১০% থেকে বাড়িয়ে ২০% করার ঘোষণা করা হয়।
•তাঁদের উৎসব ভাতা (বোনাস) ৫,৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬,০০০ টাকা করা হয়েছে।
•তবে, কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া, বেতন ও তাঁদের দিয়ে পুলিশি কাজ করানোর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শীর্ষ আদালত রাজ্যকে হলফনামা দিয়ে তাঁদের নিয়োগের আইনি ভিত্তি এবং কাজের ক্ষেত্র স্পষ্ট করতে নির্দেশ দিয়েছে।
কর্তব্যের চাপ, কম বেতন আর সামাজিক সম্মানের অভাব— এই তিনের চক্রব্যূহে আজ রাজ্যের লক্ষাধিক সিভিক ভলান্টিয়ারদের জীবন জর্জরিত। স্থায়ী কর্মীদের সমতুল্য কাজের স্বীকৃতি, বেতন ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের দাবি এই সুবিশাল বাহিনীর মনে এক তীব্র হতাশার জন্ম দিয়েছে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
Comments
Post a Comment