উপহারের চাপ

লৌকিকতার শৃঙ্খলে আটক আন্তরিকতা—উপহার এখন ভালোবাসার প্রতীক, না 'বাধ্যতামূলক ট্যাক্স'?
📝কাজলকান্তি কর্মকার [M:9933066200]: উপহার—শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে আসে ভালোবাসা, স্নেহ, শুভেচ্ছা আর আন্তরিকতার ছবি। প্রিয়জনকে উপহার দিতে কখনও খারাপ লাগে না, মনে চাপও তৈরি হয় না। সেজন্য তাদের কারণ-অকারণেই নানা ধরনের উপহার দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থে সেই ভালোবাসার উপহারে উভয় পক্ষই মনে মনে পরিতৃপ্তি লাভ করে। তার জন্য বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাধ্যতামূলক উপহার দেওয়ার প্রথাটি বহু মানুষকে চাপে ফেলে দিচ্ছে। এই আধুনিক যুগে আমাদের সমাজে উপহারের ধারণাটি এক গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। উপহার দেওয়ার সামর্থ না থাকলে বা দেওয়ার মানসিকতা না থাকলে আপনাকে নিয়ে সমাজ উপহাস, বিদ্রুপ করবে, উপহাস করবে। কিন্তু আপনার-আমার মতো অনেকেই আজ মনে মনে প্রশ্ন তুলছি, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দেঁতো হাসি হেসে যে উপহারগুলো তুলে দিই সেটা কতটা আন্তরিক? কতজন মানুষ মন থেকে উপহার দেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বাধ্যতামূলক রেওয়াজ, যা মধ্যবিত্তের সংসারে এনেছে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। আনন্দ-উৎসবের নেমন্তন্ন এখন অনেকের কাছেই আতঙ্কের কারণ। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিমন্ত্রণ পাওয়ার সময় মনে হয় প্রকারন্তে উপহারের জন্যই এই আহ্বান। কয়েকটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন—
•ঘটনা এক:— 
ছোট্ট দুই ভাইবোন মামার বাড়িতে এসেছে মামাতো দিদির বিয়েতে। মামিদের চোখ চাওয়া-চাওয়ির কারণটা তারা বুঝতে পারল যখন এক মাসি বলেই ফেলল, ‘তোদের বাড়ি থেকে কী লৌকিকতা পাঠিয়েছে দে এবার!’ 
•ঘটনা দুই:— 
বিয়ের উপহার খুলতে বসে চক্ষু ছানাবড়া দম্পতির। সবই যে সুন্দর ঢাউস প্যাকেটে ভরা কমদামী কাঁচের বাসন! ওই উপহার দেখে দম্পতি বেজায় চটে গেলেন। কারণ তারা আরও ভালোমানের উপহার প্রত্যাশা করেছিলেন।
ঘটনা তিন:—
আমি নিজে ঘাটাল শহরে একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর পুত্র সন্তানের অন্নপ্রাশনের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে গিফট নিতে এবং দিতে পছন্দ করি না। অনুষ্ঠানের দিনে আমাকে বাড়ির লোকজন সোজা নিয়ে গেলেন বাচ্চাটির কাছে। আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ না-করেই আলতো ছুঁয়ে দিলাম বাচ্চাটির চিবুক, ললাটে চুম্বন এঁকে ভোজ খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। উপহার না দেওয়ার জন্য তারপর থেকে  আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন বাচ্চাটির বাবা-মা। উপহার না দেওয়া নিয়ে আমার বিরুদ্ধে যা-তা মন্তব্যও করেছেন। পরে বুঝলাম, আমার উপস্থিতি নয়, ওরা উপহার ভিক্ষে নেওয়ার জন্যই আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। 
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যখনই তাদের কোনও আত্মীয় বা পরিচিতদের বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নেমন্ত্রণ আসে তখনই সেই পরিবার প্রধানের মাথায় হাত পড়ে যায়। লৌকিকতার দায় মেটাতে কখনও টাকা ধার করতে হয়। ছেলের টিউশনের টাকা বাকী রাখতে হয়। কিম্বা ওষুধের খরচ কমাতে হয়, মাসিক রেকারিং জমা বন্ধ রাখতে হয়। যখন লৌকিকতার জন্য উপহার কেনা হয় বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস মেশানো থাকে সেই উপহারে। সেই সমস্ত দীর্ঘশ্বাস মেশানো উপহার নিয়েই আত্মীয় পরিজন বাড়ি যেতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, উপহার দেওয়ার বিষয়টি এড়াতে অনেকে অনুষ্ঠান বাড়ি এড়িয়েও চলেন।
লৌকিকতার দায়: মধ্যবিত্তের কাঁধে চেপে বসা বোঝা সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন—বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান—এগুলিতে নিমন্ত্রণ আসা মাত্রই পরিবারের প্রধানের কপালে ভাঁজ পড়ে। কারণ এই নিমন্ত্রণ আর কেবল আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার আমন্ত্রণ নয়, এটি যেন এক অলিখিত উপহারের 'ট্যাক্স'। লৌকিকতার সামাজিক চাপের ভয়াবহতা এখানে প্রকট।
১. আগেই বলেছি, আর্থিক চাপ ও দীর্ঘশ্বাস লৌকিকতা রক্ষা করতে গিয়ে অনেক পরিবারকে টাকা ধার করতে হয়, সন্তানের টিউশন ফি বাকি রাখতে হয়, কিম্বা ওষুধের খরচ কমাতে হয়। একটি শুভ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য এই যে দীর্ঘশ্বাস মেশানো উপহার কেনা হচ্ছে, তা কি আদৌ কোনও শুভ বার্তা বহন করে? অপ্রয়োজনীয় 'রেওয়াজ' মেটাতে গিয়ে জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলি উপেক্ষিত হচ্ছে।
২. মান-সম্মানের মাপকাঠি ‘তোদের বাড়ি থেকে কী লৌকিকতা পাঠিয়েছে দে এবার!’—এই ধরনের বাক্যগুলি প্রমাণ করে যে উপহার এখন সম্পর্ক বা শুভকামনার প্রতীক নয়, বরং সামাজিক 'স্ট্যাটাস' বা লেনদেনের মাপকাঠি। উপহারের মান নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সমালোচনা হয়, যা পরবর্তীকালে কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা হবে বা না হবে—তার সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকে। দামি উপহার দিয়ে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা এই সঙ্কটকে আরও বাড়িয়েছে। উপহারের নামে 'ভিক্ষাবৃত্তি' ও সম্পর্কের অবনতি আজকের সমাজে উপহার অনেক ক্ষেত্রেই এক অলিখিত অর্থনৈতিক চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা পরিবারগুলির একটি অংশ প্রত্যাশা করে যে উপহারের মাধ্যমে সেই খরচ পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এটি এক প্রকার 'উপহারের বিনিময়ে খাদ্য' (উ-বি-খা), যা ভালোবাসার আদান-প্রদান নয়, বরং এক ধরনের আর্থিক হিসাবনিকাশ। অনেক অনুষ্ঠানেই উপহার গ্রহণ করার জন্য খাতাপত্র নিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকে—কে কত মূল্যের জিনিস বা টাকা দিল, তার হিসেব রাখা হয়। এই প্রবণতা উপহারকে  আন্তরিকতার আদান-প্রদান থেকে ব্যবসায়িক লেনদেনে পরিণত করেছে। এর বিপরীতে, শুধু আন্তরিকতা দিয়ে আলতো ছোঁয়া বা কপালে চুম্বনই যেখানে শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল, সেখানে উপহার না পেয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘটনা প্রমাণ করে যে অনেক ক্ষেত্রে সম্পর্ক টিকে থাকে উপহারের বিনিময়ে, অনুভূতির বিনিময়ে নয়। উপহারের প্রত্যাশা এতটাই যে, এই অর্থনৈতিক চাপ এড়ানোর জন্য অনেকে প্রিয়জনের শুভ অনুষ্ঠানও এড়িয়ে চলেন।
মুক্তির পথ: ওই দীর্ঘশ্বাস মেশানো উপহার পরিজনদের শুভকাজে নেওয়াটার প্রয়োজন সত্যি আছে কী? সত্যিই ভাবা যায় না লাখ লাখ টাকা খরচ করে যে পরিবার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কেন তারা সামান্য কিছু উপহারের জন্যে মুখিয়ে থাকে! এটাও তো প্রকারান্তরে ভিক্ষাবৃত্তি! যারা এখনও উপহার দিতে-নিতে অভ্যস্থ তারা জানেন নিতে ভালো লাগলেও দিতে কেমন লাগে! তাই আগে নিজে নেওয়া বন্ধ করুন, তবেই সাবলীল ভাবে খালি হাতে অন্যের অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন। পারলে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত বা অনিচ্ছার উপহার দেওয়া ও নেওয়া অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।
এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ এবং মানসিকতার পরিবর্তন। 
উপহার বর্জন নীতি: নিমন্ত্রণপত্রে স্পষ্টভাবে 'সকল প্রকার লৌকিকতা বর্জনীয়' অথবা 'উপহারের প্রয়োজন নেই, আপনাদের উপস্থিতিই আমাদের কাম্য'—এই বার্তাটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
নেওয়া বন্ধ করুন, দেওয়াও বন্ধ হবে: পরিবর্তনের শুরুটা নিজেকেই করতে হবে। নিজে উপহার নেওয়া বন্ধ করলে তবেই মানুষ দ্বিধাবোধ না করে খালি হাতে অন্য অনুষ্ঠানে যেতে পারবে। উপহারের জন্য আলাদা টেবিল বা হিসাব রাখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
আন্তরিকতাকে গুরুত্ব দিন: বস্তুর পরিবর্তে শুভেচ্ছা কার্ড, একগুচ্ছ ফুল, বা কেবল আন্তরিক হাসি—এগুলিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আন্তরিকতার প্রকাশই যেন সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি হয়। উপহারের আদান-প্রদান যখন স্বতঃস্ফূর্ত ও নিঃস্বার্থ হয়, তখনই তা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বাড়াতে সাহায্য করে। লৌকিকতার চাপমুক্ত একটি সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য উপহারের এই রেওয়াজকে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার পথে ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য। সম্পর্ককে লৌকিকতার দায় থেকে মুক্ত করে বিশুদ্ধ ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে তোলার সময় এসেছে।
•নীচের ভিডিওটি দেখতে পারেন 

https://youtu.be/3aZ1AFOYYz4



💬কাজলকান্তি কর্মকার || রাজ্যের প্রথম শ্রেণির একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক
ঘাটাল || পশ্চিম মেদিনীপুর
M&W: 9933066200
eMail: ghatal1947@gmail.com
FB:  https://www.facebook.com/KKarmakarGhatal/

Comments